মনে করুন, কোন এক সুন্দর আলো ঝলমলে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, আপনার চারপাশ জলমগ্ন হয়ে আছে। কি করবেন তখন ? গ্রীণ হাউজ এফেক্টের প্রভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে পৃথিবী। বরফের রিজার্ভ গলে যাচ্ছে আশংকাজনক হারে। দেখা দিচ্ছে নানা রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রকৃতির আশ্চর্যকর সহণশীলতা প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে তার ভারসাম্য। আমাদের বাসস্থান সৌরজগতের এই সবুজ গৃহ, পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৭০০ কোটি প্রায়। সময়ের সাথে স্বাভাবিক নিয়মে বেড়েই চলেছেএর হার। ফলশ্রুতিতে কমছে মোট কৃষি জমির পরিমাণ। চাহিদার তুলনায় জোগান পর্যাপ্ত না হওয়ায় দেখা দিচ্ছে খাদ্য ঘাটতি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে এই খাদ্য ঘাটতির প্রতিকূলতা কিছুটা সামাল দেয়া গেলেও , এর স্থায়ী কোন সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি। আবাসন সংকট নিরসনকল্পে ক্রমাগত নগরায়নের দিকে ঝুঁকছে বর্তমান পৃথিবী। তৈরী হচ্ছে অসংখ্য মেগাসিটি। মাইলের পর মাইল কৃষিজমি উজাড় করে তৈরী করা হচ্ছে সুবিশাল সুপার স্ট্রাকচার। টেকসই প্রযুক্তি আর দৃষ্টিনন্দন আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের সুসম সমন্বয় সাহায্য করছে এ’সব স্ট্রাকচার গড়ে তুলতে।
খাদ্য , আবাসনের মতো আরো অসংখ্য ধরণের সংকট মোকাবেলায় অদূর ভবিষ্যতে নাগরিক সভ্যতা সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। হয়তো তখন ভাসমান আবাসিক প্রকল্প এবং সামুদ্রিক মাছ ও শৈবালসহ সামুদ্রিক উৎস আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। মেটাবে আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন। কিন্তু, সেই নির্ভরশীলতার স্বরূপ কেমন হবে, তার সফল কোন প্রায়োগিক উদাহরণ আমরা দেখতে পাইনি।
১৯৭৭ এ জন্ম নেয়া ভিনসেন্ট ক্যালিবাউট { Vincent Callebaut} নামে একজন বেলজিয়ান আর্কিটেক্ট প্রথম শোনালেন এ’ধরণের একটি ধারণার গল্প। তিনি বললেন, আমাদের জন্য একটি উভচর সামুদ্রিক বাসস্থানের কথা। যেখানে আমাদের বাঁচার সব ধরণের উপাদানের সমন্বয় ঘটবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ফাইসালিয়া { Physalia} নামের একটি অর্ধেক নৌকা এবং অর্ধেক বাড়ি আকৃতির একটি জাহাজ তৈরী করলেন । যার বায়োনিক গঠন bionic ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং জলভিত্তিক। ফাইসালিয়া শব্দটি গ্রিক। ভিনসেন্ট physalis থেকে “Physalia physalis”, যার অর্থ “জল বুদ্বুদ” থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছেন এই জলের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কানভার্টেট সিস্টেমে রূপান্তরের মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ জীবনাধার তৈরী করবেন। তার প্রাথমিক লক্ষ্যস্থল ছিলো ইউরোপ মহাদেশের নদীগুলো।
তার নির্মিত এই উভচর জলযানটি শুধু মানুষকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাসস্থানের নিশ্চয়তাই দেবে না, একইসাথে এটি হবে একটি ফুল অটোমেটিক ওয়াটার পিউরিফাই কনসোল। যার একটি অপরিহার্য কাজ হবে তার চলার পথের জলের ধারাকে পরিশোধন করা। সম্পূর্ণ আবাসিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত এ জলযানটি চলন্ত অবস্থায় পানের অযোগ্য জলকে পানযোগ্য করে তুলবে। নদীগুলোর দূষণ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এছাড়া জলযানটি যে পরিমাণ শক্তি খরচ করবে, তারচেয়ে বেশি শক্তি সে নিজেই তৈরী করতে পারবে। অসম্ভব এই কাজটির ইতিমধ্যে একটি ডেমো দেখানো হয়েছে।
জাহাজের বাইরের আবরন টাইটেনিয়াম ডাই অক্সাইড নির্মিত হবার ফলে এটি আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি শোষণ করার মাধ্যমে এ’সংক্রান্ত দূষণ রোধ করতে পারবে। জৈব ও অজৈব দুই ধরণের বিষক্রিয়াই এটি নিউট্রালাইজ করতে সক্ষম।
শক্তির ব্যাপারে বলা হয়, এটি সোলার এবং হাইড্রো পাওয়ার তৈরী করতে পারে। জাহাজের ডেকে তৈরী করা হয়েছে বিশাল বাগান। গাছগুলো বেছে নেয়া হয়েছে তাদের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে। জলের দূষণ কমাতে সক্ষম, এ’ধরণের উদ্ভিদ বৈজ্ঞানিক উপায়ে সতর্কতার সাখে রোপণ করা হয়েছে। জাহাজের ভেতরে রয়েছে বিশাল এক ল্যাব। জলজ বাস্তুতন্ত্র নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের জন্য এটা একটা স্বর্গ বলা যেতে পারে।
সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ হচ্ছে এর সাবমার্জড লাউঞ্জ অর্থাৎ, জলের নিচের অবজারবেশন ফ্যাসিলিটি। যা উন্নত বিশ্বের যেকোন ফাইভ স্টার হোটেল কিংবা ক্যাসিনোর চেয়ে অধিক চোখধাঁধানো হবে। ভিনসেন্ট ২০১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স এর আন্তর্জাতিক জল সম্পর্কিত আলোচনার প্রেক্ষিতে এই কনসেপ্ট বাস্তবায়নে অগ্রসর হন।
তিনি নোমেডিক হাইড্রোডাইনামিক ল্যাবরেটরি, ফ্রাগমেন্ট অব লিভিং আর্থ, জিওগ্রাফিক্যাল স্কেল ও ফ্লটিং আগোরা এ চারটি প্রজেক্টের সমন্বিত রূপ দিতে এটি তৈরী করেছেন।
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আমাদের টিকে থাকা সুনিশ্চিত করার কাজ নিরলস কিছু প্রতিভাবান মানুষের মাধ্যমে করিয়ে নিচ্ছে। ভিনসেন্ট ক্যালিবাউট সেই সব পাইওনীয়ারদেরই একজন।
সবুজ এই গৃহটাকে যেনো সবুজায়নের মাধ্যমে বাসযোগ্য রাখা যায়, সে লক্ষ্যে এই মানুষটির আরো অনেকগুলো গ্রীন প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে। তার মধ্যে আছে কোরাল রীফ রেসিডেন্টাল প্রজেক্ট , বায়োলজিক্যাল টাওয়ার, আরবান গ্রীন ফ্রেমিং প্রজেক্ট, ফ্লোটিং ক্লাইমেট চেঞ্জিং প্রজেক্ট ফর ওশেনস ইত্যাদি অনেকগুলো অসাধারণ সব ইউনিক প্রকল্প। এই সৃষ্টিশীল মানুষটি ভূষিত হয়েছেন নানা রকম পুরষ্কারে।
তিনি স্বপ্ন দেখেন, একদিন এই পৃথিবী আরো সবুজ হয়ে উঠবে। কল-কারখানা, শহর-নগর বন্দর সবখানে থাকবে সবুজায়নের ছোঁয়া..।. প্রকৃতির অফুরন্ত শক্তিকে এই ফাইসালিয়া প্রজেক্টের মতো অসংখ্য পদ্ধতিতে কাজে লাগবে সে সময়ের প্রজন্ম।
বর্তমান সময়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে সাগর-মহাসাগরগুলো। অপরিশোধিত আবর্জনা পরিশোধনে অনীহা দেখাচ্ছে রাষ্ট্রগুলো। আমাদের সমুদ্র সৈকত দেখলে কিছুটা অনুমান করা যায় পরিস্থিতি।
ফাইসালিয়ার মতো কিংবা এরচেয়ে আপডেটেড কোন প্রযুক্তি হয়তো আমাদের সাগর-নদীগুলো সুন্দর রাখতে সহায়তা করবে।
প্রসঙ্গতঃ এখানে বুড়িগঙ্গা নদীর কথা বলা যায়। যে নদী জন্ম দিয়েছে ৪০০ বছরের পুরোণো ঢাকা নগরীকে। প্রাণের স্পন্দন যুগিয়েছে। মানুষের জীবিকার প্রয়োজন মিটিয়েছে অকাতরে। সুবিশাল আকার নিয়ে সগৌরবে বয়ে যেতো ঢাকার গাঁ ছুঁয়ে।
সেই বুড়িগঙ্গা এখন বিপন্ন। ভূমি দস্যু দখলদারদের আগ্রাসনে ছোট হয়ে আসছে তার বিস্তার। জলের রং দেখলে ভয় ধরে যায়। মেগাসিটি ঢাকার রাজ্যের আবর্জনা ড্রেনেজ পাইপগুলোর বর্জ্য এসে পড়ছে এই নদীতে।
আমি আশাবাদী মানুষ। প্রিয় এই দেশটা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন আমাদের দেশের মেধাবী তরুণরা ভিনসেন্টের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন সৃজনশীল পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা আর আমাদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়া এই মেগাসিটিকে রক্ষা করবে ধ্বংসের হাত থেকে।
বহুকাল পূর্বে বুড়িগঙ্গায় যেমন ভেসে বেড়াতো নবাবদের ময়ূরপঙ্খী নৌকা। অদূর ভবিষ্যতে তেমনি একদিন বুড়িগঙ্গায় ভাসবে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অলংকৃত, চমৎকার কোন জলযান। অন্য আরেক ফাইসালিয়া..।.আমি জানি, আমাদের দেশে ভিনসেন্টের মতো অসংখ্য মেধাবী মুখ রয়েছে। তাঁরা অনেক কিছু করে দেখাতে পারবে।
শুধু প্রয়োজন হবে পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারের সদিচ্ছা এবং পরিকল্পনাহীনতার অভাবে প্রতিবছর ভিনদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে আমাদের মেধাগুলো। উপযুক্ত কাজের পরিবেশ এবং সংশ্লিষ্ট সকলের পরিকল্পিত পদক্ষেপ আমাদের মেধাগুলোকে আমাদের কাছেই থেকে যেতে সাহায্য করবে। আমার গভীর বিশ্বাস, আমরা পারবো, আমাদের এই মাতৃভূমিকে অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে দিতে…।. প্রিয় এই দেশটার ভালো একদিন হবেই।
প্রযুক্তির মহান শিল্পী, স্রোতের উল্টোপথে চলা, আর্কিটেক্ট ভিনসেন্ট ক্যালিবাউটের মতো আরো যারা যুগে যগে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের সবার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনধারণের সহায়ক হোক। কখনোই আমরা চাইনা, প্রযুক্তির অপব্যবহার। মুক্ত আকাশের মতো মুক্ততায় বেড়ে উঠুক বর্তমান পৃথিবী। বেঁচে থাকুক সহস্র বছর ধরে।
2 মন্তব্য(গুলি):
এটা কি কখন ও সম্ভব?
এক না এক দিন তো সম্ভব করতেই হবে।
Post a Comment
ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য