আসলে, বলপ্রয়োগে তরলের প্রবাহ নির্ভর করে জিনিসটা কতটা ঘন তার ওপর। ‘ঘন’ কথাটা লিখলেও এর সাথে ঘনত্বের কোনও সম্পর্ক নেই। জলের ঘনত্ব কেরোসিন তেলের ঘনত্বের থেকে অধিক, কিন্তু ঢালার সময়ে পতনের ব্যাপারে জল বেশি ‘চটপটে’। ‘ঘন’-র পরিবর্তে ‘আঠালো’ কথাটা বোধকরি এক্ষেত্রে বেশি লাগসই।বস্তুতঃ, তরল পদার্থের বিভিন্ন স্তরের পরস্পরের সাথে এঁটে থাকার আছে এক অদ্ভুত প্রবণতা। বিভিন্ন তরলের এই প্রবণতা বিভিন্ন রকমের। মধুর তুলনায় দুধ ঢালা যে সহজ, তা তুলনামূলক ভাবে দুধের আঠালো ভাব কম থাকার কারণেই।
ভেতরের ব্যাপার
তরলের এই হালচাল থেকে প্রতীয়মান হয়, এক ধরনের আভ্যন্তরীণ রোধ (ইন্টারনাল ফিকশন) তরলের ভেতর বিরাজমান। এই রোধের কারণে শুধু নিজের চলনকে নয়, গতিশীল বস্তুকেও বাধা দেয় তরল। ডুব সাঁতার দেবার সময় জলের বাধা অনুভব করা যায়। আভ্যন্তরীণ রোধ তরলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌত ধর্ম। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘সান্দ্রতা’ (ভিসকোসিটি)।. পোশাকি নাম ব্যবহার না করলেও রোজকার কথাবার্তাতে আমরা কিন্তু হামেশাই এর উল্লেখ করে থাকি। ‘সরষের তেলের থেকে পাম তেল ভারী’ বা ‘এই ব্রান্ডের লিকুইড সোপ বেশ পাতলা’ – গোছের বক্তব্য আদতে তেল বা তরল সাবানের সান্দ্রতা নিয়েই। তরলের মতো গ্যাসেরও আছে সান্দ্রতা। বাতাসের সান্দ্রতা আছে বলেই তারস্বরে বাজতে থাকা মাইকের কান-ফাটানো আওয়াজও দূরত্বের সাথে স্তিমিত হতে হতে অবশেষে মিলিয়ে যায়। বিভিন্ন গ্যাসের সান্দ্রতার মান আলাদা। সমান চাপে ও উষ্ণতায় অক্সিজেন হাইড্রোজেনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন সান্দ্র। অবশ্য তরলের তুলনায় গ্যাসের সান্দ্রতা খুবই কম। বাতাসের সান্দ্রতা জলের সান্দ্রতার মাত্র দুই শতাংশ।
সান্দ্রতার সাতকাহন
খুব ঠান্ডার দিনে গ্লিসারিন শিশি থেকে বেরোতে চায় না। এই সমস্যার সহজ সমাধান যে শিশিটিকে গরম করা, তা সকলেরই জানা। তাপ প্রয়োগই হচ্ছে ‘মোটা’ তরলকে ‘পাতলা’ বানানোর মোক্ষম কৌশল! কায়দাটা কেউ যদি গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে যান, তিনি কিন্তু ডাহা ঠকবেন! কেননা গ্যাসের সান্দ্রতা উষ্ণতা বাড়ার সাথে কমে না, বরং বাড়ে। বাতাসের উষ্ণতা ক্ষেত্র-বিশেষে তাই হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবহাওয়া হিসেব-মাফিক না থাকলে মহাকাশে রকেট পাঠানোর কর্মসূচীও শেষ মুহূর্তে স্থগিত করতে হয়।
তাপের পরে স্বাভাবিকভাবেই আসে চাপের প্রসঙ্গ। চাপ বাড়ালে তরলের সান্দ্রতা বাড়ে। এই সাধারণ নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম জল। চাপের পরিবর্তনের সাথে জলের ভিসকোসিটির তেমন কোনও হেরফের হয় না। গ্যাসের সান্দ্রতাও চাপের সাথে পাল্টায় না।
শেষ পাত
সান্দ্রতা আমাদের জীবনে প্রাভাব ফেলে নানাভাবে। সরু, লম্বা গলার শিশিতে কেউই মধু রাখতে চাইবেন না। তরল পদার্থ হওয়ার দরুন জীবনদায়ী রক্তেরও আছে সান্দ্রতা। জলের সান্দ্রতার চেয়ে রক্তের সান্দ্রতা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। জ্বর হলে দেহের উষ্ণতা বাড়ে। টেম্পারেচার বাড়ায় রক্তের সান্দ্রতা কমে। অতএব, বাড়ে তারল্য। ফলে হার্টের পক্ষে দেহের সর্বত্র রক্ত পৌঁছে দেওয়ার কাজ কিছুটা সহজ হয়। পক্ষান্তরে, কোনও কারণে রক্তের সান্দ্রতা বাড়লে হার্টের ওপর চাপ পড়ে। দীর্ঘকাল এভাবে চললে আশঙ্কা থাকে অসুস্থ হওয়ার। বাতাসের সান্দ্রতার ব্যাপারটা দ্রুত গতিসম্পন্ন যানের ডিজাইনারদের মাথায় রাখতেই হয়। বাতাসের রোধ কমানোর জন্য এই প্রকার যানকে হতে হয় ধারারেখিত (স্ট্রিমলাইনড্) আকারের। জাপানের বুলেট ট্রেন কিংবা এরোপ্লেনের ‘নাক’ টিকলো হয় ঠিক এই কারণেই!
1 মন্তব্য(গুলি):
odvut sundor.valo laglo
Post a Comment
ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য